সেদিন সকালে

সেদিন ছিল ফাল্গুনের মিঠে রোদ মাখানো সকাল। সুজন সকালের সব কাজ শেষ করে একটা বই নিয়ে বসেছিল। এমন সময় রেখা এসে উপসি'ত হয়।

রেখার সঙ্গে সুজনের পরিচয় তার এক বন্ধু হাসান সাহেবের বাসায়। হাসান সাহেবের বাসায় সুজন মাঝে মাঝে যায়। আর সেখানে গেলে অনেক সময় রেখার সঙ্গে তার দেখা হয়। হাসান সাহেব যে বাসায় থাকেন তার কাছাকাছি এক বাসায় রেখারা থাকে। হাসান সাহেবের স্ত্রীর সঙ্গে রেখার সম্পর্কটা বেশ ভাল। সেই সূত্রে আসা। তাছাড়া হাসান সাহেব এক কলেজে অধ্যাপনা করেন। লেখাপড়ার কিছু বিষয় রেখা মাঝে মাঝে তার কাছ থেকে বুঝে নেয়। মেয়েটাকে সুজনের এমনিতে ভালই লাগে। বেশ হাসিখুশী, স্মার্ট। মিষ্টি চেহারার।

সুজন রেখাকে দেখে একটু অবাক হয়। কারণ রেখা কিছুদিন আগে সুজনের ঠিকানা নিলেও এর আগে আসে নাই। রেখা বলেছিল, সুজন ভাই! আপনার ঠিকানা দিতে আপত্তি আছে কি?

না, আপত্তি থাকবে কেন? তুমি এলে খুশী হব। কিন্তু তুমি তো জানো আমি একা থাকি। তোমারই না সংকোচ হয়।

রেখাকে প্রথম দিকে সুজন আপনি করে বলত। কিন্তু রেখা কয়েকদিন প্রবল আপত্তি করে, আমাকে আপনি করে বললে কিন্তু আমি আপনার সঙ্গে কথা বলব না। আপনি তো আমার চেয়ে অনেক বড়। আমাকে আপনি তুমি করে বলবেন।

শেষ পর্যন্ত রেখার কথাই বহাল হয়। আসলে দুই জনের বয়সের ব্যবধানটা অনেক। রেখার বয়স কত হবে? মেয়েদের বয়স জিজ্ঞাসা করতে নাই। তবে অনুমান করে ঊনিশ কুড়ি হবে। সুজনকে দেখতে এখনো অনেক কম বয়সী তরুণের মত মনে হলেও সে কখনো নিজের বয়স লুকায় না। অনেকের কাছেই বিস্ময়কর মনে হয়, পঁয়ত্রিশ বৎসর বয়স হলেও সে বিয়ে করে নাই কেন!

মেয়েদের প্রতি তার অনীহা বা আসক্তি কোনটাই বোঝা যায় না। এমনিতে সে অমিশুক নয়। কিন্তু কোথায় যেন নিজের চারপাশে একটা অদৃশ্য দেওয়াল দিয়ে রাখে। হাসিখুশী, ভদ্র আর নম্র হলেও একটা দৃঢ় ঋজুতা শুধু তার শরীরে নয় মনেও যে রয়েছে এটা বুঝতে কারোরই খুব একটা কষ্ট হয় না।

বন্ধু
স্থানীয় কেউ কেউ বলে, এখন একটা বিয়ে করে ফেলুন। আর কত দেরী করবেন? নাকি এখনো বিপ্লবের পোকা মাথায় আছে?

বিপ্লবের পোকা মাথায় থাকা শুধু নয়, সে যে এক সময় বিপ্লবী আন্দোলনের একজন একনিষ্ঠ কর্মী ছিল এটা অনেকে জানে। ষাটের দশকের শেষ দিকে সে ছাত্র জীবন শেষ করে কৃষকদের মধ্যে কাজ করার জন্য গ্রামে চলে যায়। একাত্তরে একটা কমিউনিস্ট দলের কর্মী হিসাবে যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিল দেশের ভিতরে থেকে। তবে বিভিন্ন প্রশ্নে দলের সঙ্গে মতান্তর আর নিজেরও বিভিন্ন সংশয়ের কারণে বাহাত্তরে সে সেই দল ত্যাগ করে। তারপর গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে আসে। নানা ঘাটের পানি খেয়ে অবশেষে বর্তমান পত্রিকায় চাকুরী করছে কয়েক বৎসর ধরে। এখন সক্রিয় রাজনীতি না করলেও নানা দলে বিভক্ত পুরাতন নেতা ও সহকর্মীদের কারো কারো সঙ্গে যোগাযোগটা রাখে। কিন্তু তাদের সঙ্গে একমত হতে পারে না বলে কোন দল করে না।

সে হেসে বলে, বিপ্লবের পোকা কি দেখা যায় যে, এটা আছে কি নাই বুঝব?

যাইহোক, এখন কিন্তু আপনার বিয়ে করা উচিত। চাকুরীতে যা পান তাতে আপনার সংসার চালাতে খুব একটা কষ্ট হবার কথা নয়। তাহলে বিয়ে করতে অসুবিধা কোথায়?

অসুবিধা আছে, তা কি বলেছি?
তাহলে?
সুজন উত্তর দেয় না, হাসে।

আসলে কি জানেন আপনার এই বই পড়া আর ভাবা রোগটা সারানো দরকার। এত বই পড়ে আর ভেবে কী লাভ?

হাঁ, এটা ঠিক সুজন একটু বেশী পড়ে। আর সে সদালাপী হলেও এবং সচরাচর হাসিখুশী থাকলেও একটু বেশীই চিন্তা করে। বলা যায় মাঝে মাঝে সে ভাবনায় মগ্ন হয়ে থাকে। সেই সময়গুলোতে এই পৃথিবীর চারপাশের কোন কিছু তাকে স্পর্শ করে না। মাঝে মাঝে সে কী যে লেখে তা কেউ জানে না। এটুকু বোঝা যায় যে, এই লেখার সঙ্গে তার পত্রিকার লেখার কোন সম্পর্ক নাই। অবশ্য এইসব লেখা সে অবসর সময়ে নিজের ঘরে লেখে। সে মাঝে মাঝে আড্ডা দিলেও সেটা সচরাচর বাইরে দেয়। তার বাসায় বাইরের লোকদের যাতায়াত কম। তাছাড়া এইসব লেখা সে প্রকাশও করে না। কাজেই অন্যদের জানবার কথাও নয়। বলা যায় অনেক মানুষের ভিড়ে সে বেশ খানিকটা একা।

বক্তারা যখন তাদের কথার জের টেনে বলে, আর যদি অনুমতি দেন তাহলে আপনার জন্য একটা মেয়ে দেখি - তখন সুজন নিজেই ব্যস্ত হয়ে বলে, না, না, এত ব্যস্ত হবার কী আছে?

কেউ কেউ বলে, আপনার নিজের কাউকে পছন্দ থাকলে বলেন, আমরা সেক্ষেত্রে আপনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করতে পারি।

তা থাকলে বলার কথা ভাবা যেত, সুজন হেসে উত্তর দেয়।

সুজনের যারা একটু ঘনিষ্ঠ বন্ধু বা আত্মীয় তারা দুঃখ পায়। কেউ কেউ বলে, এভাবে জীবনটা নষ্ট করো না। এবার ঘর-সংসার করো।

সুজন উত্তর দেয়, কেন আমার কি ঘর-সংসার নাই? তাহলে আমি থাকি কোথায়? গাছতলায় তো থাকি না।

এ কথার কি আর উত্তর হয়? সুতরাং বিয়ের ব্যাপারে কথা বেশী দূর এগোতে পারে না।

মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়ীতে গেলে মা-বাবাও তাকে বিয়ের জন্য পীড়াপীড়ি করেন, জীবনের অনেকটাই তো নষ্ট করেছিস। এখন যা হোক একটা চাকুরী করছিস। এবার বিয়ে করে সংসারী হ’।

সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তর দেয়, ভেবে দেখি।

কখনো বিরক্ত হয়ে মা বলেন, না কি বিয়ে করবি না ঠিক করেছিস?

না, মা, এমন সিদ্ধান্ত তো আমার কোনোদিনই ছিল না, এখনো নাই।

তবে কেন দেরী করছিস? হয় আমাদের পছন্দে বিয়ে কর আর নয় নিজে কাউকে পছন্দ করে বিয়ে কর। তোর জীবনটা আমার চোখের সামনে এভাবে নষ্ট হচ্ছে ভাবলে আমার খুব কষ্ট হয়।

আমাকে নিয়ে বেশী ভেবে নিজেকে কষ্ট দিও না মা!

তুই আর কোন দিন বাপ-মা’র কথা শুনলি! - মা ক্ষুব্ধ স্বরে বলেন।

বাড়ীর বড় ছেলে হলেও নিজ পরিবারের প্রতি কোন দায়িত্ব সে পালন করতে পারে নাই। বাবা-মা যেভাবে পেরেছেন তার অন্যান্য ভাইবোনকে মানুষ করেছেন। এখন তো যে যার মত আপন সংসার নিয়ে ব্যস্ত। বাবা-মা একাই থাকেন। জমি-জমা যা আছে তা দিয়ে তাদের দু’জনের স্বচ্ছন্দে চলে যায়। গ্রামের বাড়ীতে দু’জনের খরচই বা আর কত!

মা খুব বিরক্ত হয়ে কখনও বলেন, তুই যে কী চাস আমি বুঝি না।

আসলে কেউ বোঝে না সে কী চায়। কিংবা তাকেই হয়ত বোঝে না। সে কি নিজেও নিজেকে ভালমত বোঝে? মাঝে মাঝে তার নিজেকে ভয়ানক একা মনে হয়। ঢাকার রাজপথ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় তার কখনো মনে হয় সে এক নির্জন প্রান্তরে একা হেঁটে চলেছে। কেউ কোথায়ও নাই। সে দেখে দিগন্ত রেখা আর সেখানে দাঁড়িয়ে আছে অচেনা অরণ্য। তার মনে হয় যে পথে সে হেঁটে চলেছে তার শেষ কোথায় সে জানে না।

একদিন রেখা বলছিল, সুজন ভাই! আপনি তো এমনিতে বেশ হাসিখুশী মানুষ। কিন্তু মাঝে মাঝে হঠাৎ করে অমন অন্যমনস্ক হয়ে কী যেন ভাবেন। আচ্ছা, কী এত ভাবেন?

সুজন হাসে, তাই বুঝি? বেঁচে থাকলে মাঝে মাঝে তো ভাবতেই হয়।

না, বাবা! আমার এত ভাবতে ভাল লাগে না। বেশী ভাবনা হলে আমার হয় কান্না পায়, নয় ঘুম পায়।

এ কথায় ওরা দু’জনেই হাসে।

ওদের দু’জনের মধ্যে মাঝে মাঝে এমন অনেক আলাপ হয়। তবে সে সব যে খুব একটা গভীরে যায় তা নয়। কখনও হয়ত সুজন প্রশ্ন করে, রেখা! বই পড়তে তোমার ভাল লাগে?

ক্লাসের বই তো বাধ্য হয়েই পড়ি। বাইরের বই পড়তেও ভাল লাগে।

কী ধরনের বই পড়তে ভাল লাগে?

গল্প, উপন্যাস আর ডিটেকটিভ বই।

কার উপন্যাস তোমার ভাল লাগে?

অনেকের তো ভাল লাগে। তবে এই মুহূর্তে শরৎচন্দ্র আর তারাশংকরের কথা মনে হচ্ছে।

কোন দিন হয়ত সুজন প্রশ্ন করে, আচ্ছা রেখা! তুমি স্বপ্ন দেখো?

ওমা, ঘুমালে তো সবাই স্বপ্ন দেখে!
না, সে স্বপ্নের কথা বলছি না। মানুষের জীবনে তো কত স্বপ্ন্তকল্পনা থাকে। আমি সেই স্বপ্নের কথা বলছি।

রেখা হাসে, হাঁ, সেই স্বপ্ন তো আমিও দেখি। তবে বোধ হয় বেশী স্বপ্ন দেখতে আমার ভাল লাগে না। আমি বাস্তব বেশী পছন্দ করি।

আচ্ছা, দেশ, সমাজ এসব নিয়ে তুমি ভাব না?

আর দশজনের চেয়ে বেশী ভাবি এ কথা বলা বোধ হয় ঠিক হবে না। আসলে এসব নিয়ে বেশী ভেবে আমার কী লাভ বলেন!

একদিন রেখা সুজনকে বলে, সুজন ভাই! আপনি তো এক সময় রাজনীতি করতেন। আচ্ছা, রাজনীতি করে আপনার কী লাভ হয়েছে? যদি রাজনীতি না করে আপনি অন্য কিছু করতেন তাহলে কি আপনার আজ অনেক উন্নতি হত না?

কোন উন্নতির কথা বলছ?

এই যেমন ধরেন, টাকা-পয়সা, বাড়ী-গাড়ী।

যারা রাজনীতি করে না তাদের সবার বুঝি এসব হয়?

না, তা হয় না।

তাহলে? বরং বেশীর ভাগ মানুষেরই তো সেসব নাই আর তাদের জীবনে অনেক দুঃখ-কষ্ট, তাই না? সেইসব দুঃখ-কষ্ট পাওয়া আর অধিকার বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য যদি কিছু মানুষ নিবেদিত না হয় তবে সমাজটা কী করে মানুষের বসবাসযোগ্য হবে বলো তো?

আপনি অনেক সুন্দর কথা বলেন সুজন ভাই, যেগুলো সবটুকু না বুঝলেও আমার শুনতে ভাল লাগে। কিন্তু আপনার মত ভাল মানুষ রাজনীতি করতে গিয়ে অনেক কিছু হারিয়েছেন মনে হলে আমার রাজনীতির প্রতি শ্রদ্ধা আসে না।

সুজন একটু হাসে, আমি ভাল মানুষ এই বুঝি তোমার ধারণা?

রেখা একটু লজ্জা পেয়ে বলে, আপনি ভাল মানুষ এটা শুধু আমার ধারণা কেন হবে এটা তো সবার ধারণা। হাসান ভাই আর ভাবী তো সব সময় আপনার প্রশংসা করেন। ওনাদের কাছ থেকে আপনার কত কথা যে শুনেছি!

হাসান সাহেবের সঙ্গে সুজনের সম্পর্ক বেশ ভাল হলেও তাদের পরিচয় বা সম্পর্ক যে ছাত্র জীবন থেকে তা কিন্তু নয়। বরং  অনেক পরবর্তী কালে তাদের মধ্যে পরিচয় এবং সম্পর্ক গড়ে ওঠে। হাসান সাহেব ছাত্র জীবনে বাম রাজনীতির সমর্থক ছিলেন। সেই সূত্রে তিনি সুজনের নাম জানতেন। তিনি ছাত্র জীবন শেষ করে একটা কলেজে অধ্যাপনা করতে ঢোকেন। রাজনীতির সঙ্গে এখন তার তেমন কোন সম্পর্ক না থাকলেও রাজনীতি, সমাজ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ভাবেন এবং সময় সময় সেসব নিয়ে সুজনের সঙ্গে আলোচনা করেন। তাদের আলোচনায় রাজনীতি ছাড়াও সাহিত্য, দর্শন ইত্যাদি বিষয় আসে। ভদ্রলোক সুজনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তার স্ত্রীও সুজনকে খুব পছন্দ করেন। সে বাসায় এলে উভয়েই খুব খুশী হন।

সুজন রেখাকে আর বলার সুযোগ না দিয়ে বলে, এখন তাহলে আমি বলি আমি যদি তোমাদের প্রশংসা পাবার উপযুক্ত মানুষ হয়ে থাকি তা কিন্তু আমি যে, এক সময় বিপ্লবী রাজনীতি করেছিলাম সেই কারণেই অনেকখানি হয়েছে তাহলেও কি রাজনীতি সম্পর্কে তোমার মত বদলাবে না?

এ কথার উত্তর না দিয়ে রেখা পাল্টা প্রশ্ন করে, রাজনীতি যদি এত ভাল হয় তাহলে আপনি কেন ছেড়েছেন?

সুজন হেসে একটু ক্ষণ ভাবে। তারপর বলে, যখন বুঝেছি ভুল পথে এগোচ্ছি তখন পথতটা বদলাতে চেয়েছি। কিন্তু সব সময় রাজনীতি করা মানে কি দল করা? এই যে দেশ নিয়ে, সমাজ নিয়ে, মানুষের জীবন নিয়ে ভাবা কিংবা কারো সঙ্গে কথা বলা তাও কি এক ধরনের রাজনীতি নয়? তাছাড়া তখন যে রাজনীতি করা প্রয়োজন মনে করেছি তা করেছি আর যখন তার প্রয়োজন নাই মনে করেছি তখন তা ছেড়ে দিয়েছি।

প্রয়োজন যার ফুরায় সেটা করা কি ভুল নয়?

তা হবে কেন? পরে তা মূল্যহীন হতে পারে কিন্তু যখন তার মূল্য ছিল সেই সময়টাকে হিসাবে না নিয়ে এক সময় তার মূল্য ফুরিয়েছে বলে তাকে শুধু ভুল বলে উড়িয়ে দেওয়া কি ঠিক? তাহলে তো মৃত্যু আছে বলে জীবনেরো কোন মূল্য থাকে না।

রেখা বলে, আপনার সঙ্গে আমি তর্কে পারব না সুজন ভাই। কাজেই আর তর্কে না গিয়ে বলব আপনার সম্পর্কে আমি যেটুকু শুনেছি অথবা আমি নিজে আপনাকে যেটুকু বুঝেছি তাতে আমি এইটুকু বুঝি যে, রাজনীতি অর্থাৎ আপনাদের ঐ বিপ্লবী রাজনীতি না করলে আপনি অনেক উপরে উঠতে পারতেন।

রেখার সঙ্গে সম্পর্ক এই রকম কিছু আলাপের বেশী তেমন একটা এগোয় নাই। তবে রেখা যে তাকে পছন্দ করে সেটা সুজন বোঝে। কিন্তু তার পরিমাণ বা ধরনটা বুঝতে পারে না। কিংবা হয়ত এ কথা বলাই ঠিক হবে যে, সেটা বোঝার জন্য তেমন একটা চেষ্টাও করে না।

রেখা এলে সে একটু অবাকই হয়। রেখা তার ঘরে ঢুকে বলে, কী সুজন ভাই! আপনাকে একট সারপ্রাইজ দিলাম, তাই না?

হাঁ, গত কালও তো তোমার সঙ্গে বিকালে হাসন সাহেবের বাসায় দেখা হল। তখনো তো বলো নাই যে আজ আসবে!

সুজনের কথার উত্তর না দিয়ে রেখা ঘরটার চারধারে তাকিয়ে বলে, বাহ্‌ ! আপনার ঘরটা তো বেশ সুন্দর করে সাজানো। আমি ভাবছিলাম একা পুরুষ মানুষ থাকেন, না জানি কেমন এলোমেলো দেখব ঘরটা।

কলোনির একটা ঘরে সুজন সাবলেট নিয়ে থাকে। সে নিজে গোছানো মানুষ। জিনিসপত্র কম হলেও সেগুলো বেশ গুছিয়ে রাখে। অবশ্য জিনিসের মধ্যে বই-পত্রই বেশী জায়গা জুড়ে আছে।

সে নিজে বিছানায় বসে। চেয়ারটা টেনে নেয় সামনে। বলে, বসো!

রেখা চেয়ারে না বসে বিছানায় বসে। সুজনের থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে। তারপর বলে, আপনাকে ধরব বলে সকাল সকাল বাসা থেকে রওনা দিয়েছিলাম। অফিসে কি এখন যাবেন, নাকি কিছু দেরী আছে?

অফিসের আর একটু দেরী আছে। তাছাড়া একদিন বেশী দেরী করলেও কোন ক্ষতি হবে না। তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে বসো। হাঁ, এবার বলো, আমি তোমাকে কি দিয়ে আপ্যায়ন করতে পারি?

না, না, সেসব কিছু করতে হবে না। আপনার ছোট সংসার দেখলাম। একটু হাসে, এবার একটু সময় গল্প করব।

সুজন তরল সুরে বলে, তথাস' ম্যাডাম! তোমার মত সুন্দরী রমণীর সঙ্গে গল্প করার সাধ জাগবে না যার সে পুরুষ তো পুরুষ কুলের কলংক।

রেখার হাসিতে জলতরঙ্গ বেজে ওঠে। তারপর কোন কথা না বলে কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে থাকে। দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁটের একটা ধার একটু কামড়ে ধরে। একটু পরই সেটাকে ছেড়ে দেয়। তারপর মাথাটা ওঠায়। সুজনের চোখের দিকে তাকায়। একটু ইতস্তত করে দৃষ্টি নামায়। তারপর বলে, সুজন ভাই! আজ রাতে আমি আপনাকে স্বপ্নে দেখেছি।

বলেই মাথাটা নীচু করে। বোঝা যায় কথাটা বলতে তার খুব লজ্জা হয়েছে এবং অনেক প্রস'তি নিয়ে প্রায় মরীয়া হয়ে বলেছে।

সুজনের হঠাৎ কেমন ভাবান্তর হয়। সে হাত বাড়িয়ে রেখার চিবুকটা একটু তুলে ধরে। এক মুহূর্ত ওর মুখের দিকে সহাস্যে চেয়ে বলে, ও মা, তাহলে তো আমি মহাভাগ্যবান! কিন্তু স্বপ্নটা সুখের না দুঃখের?

মুহূর্তে ঘটনাটা ঘটে। রেখা সুজনের হাতটা দু’হাতে জড়িয়ে ধরে তার বুকে টেনে নিয়ে সুজনের কাঁধে মাথা রাখে। সেই মুহূর্তে সুজনের চেতনায় যেন একটা বিস্ফোরণের মাধ্যমে তার পুরুষ সত্তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে মুহূর্তে তাকে জড়িয়ে ধরে। রেখাও তার কোমল বাহুতে বাঁধে তাকে। দু’জনের অধরে অধর  মিশে যায়। সুজন রেখাকে চুম্বনে, পেষণে তছনছ করে দিতে চায়। সুজনের অধরে রেখার দীর্ঘ, ব্যাকুল চুম্বন তার ভিতরটা মাতাল করে তোলে। যেন তখন ঝড়ের মাতামাতি দু’জনের বুকে, শরীরে, মনে। রেখার শরীরে তখন বৈশাখের রোদের তীব্র দহন। কেন এই পুরুষ তার দহন প্রবল ঝড়ের পর বৃষ্টির ধারা দিয়ে নেভায় না?

রেখার অনাবৃত নরম বুকে সুজন মুখ ডোবায়। আর তখন যেন অনেক দূর থেকে ফিস ফিস শব্দের মত অস্পষ্ট ধ্বনি ভেসে আসে তার কানে, সুজন! আমি তোমাকে ভালবাসি।

মুহূর্তে সুজনের বুকের ভিতরে যেন একটা তীর এসে গেঁথে যায়। ক্রমে তার বাহু শিথিল হয়ে আসে। তার পৌরুষের ঋজুতা নিয়েও তীরবিদ্ধ যন্ত্রাণাকাতর হরিণের মত রেখার বুক থেকে ধীরে ধীরে মাথা তোলে, তার আধখোলা বিবশ দু’চোখের উপর দৃষ্টি রাখে। রেখার দু’চোখে তখন হেম
ন্তের রাত্রির কুয়াশায় অস্পষ্ট জ্যোৎস্নার আলো ঝরছে। একটু লাজুক হাসির রেখা ফুটে ওঠে তার দু’চোখে। অস্পষ্ট স্বরে বলে, প্লিজ! আর পারছি না।

সুজন আলতো করে তার ঠোঁটে একটা চুম্বন করে। তারপর ধীরে ধীরে নিজেকে কিছুটা আলগা করে নিয়ে রেখার চুলে হাত বুলায়। ততক্ষণে প্রবল উত্তেজনা রেখার শরীরে তীব্র যন্ত্রণায় রূপ নেয়। তার তলপেটে তীব্র ব্যথা জাগে। ব্যাথাটা ঢেউয়ের মত শরীরে ছড়ায়। সেটা দ্রুত আক্ষেপে পরিণত হয়। রেখা কাতর হয়ে বলে, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। - তার বুকের ভিতর থেকে অস্ফুট আর্তনাদ ঠেলে ওঠে। একটা আহত হরিণীর মত সে যেন মোচড়াতে থাকে।

সুজন মুহূর্ত খানেক হতভম্বের মত চেয়ে থাকে। তারপর মুহূর্তে তার করণীয় ঠিক করে ফেলে। সে রেখাকে ছোট্ট একটা মেয়ের মত বুকে জড়িয়ে ধরে তার পিঠ
আস্তে আস্তে চাপড়ে দিতে থাকে। তার কপালে, দু’চোখে চুম্বন করে। এবারে তার আদরের ধরনটা অনেক ভিন্ন।

বলে, লক্ষ্মী মেয়েটা একটু শান্ত হও!

সুজন ততক্ষণে নিজে শান্ত হয়ে গেছে। রেখার মাথাটা তার বুকের উপর রাখা। চিৎ হয়ে শোওয়া সুজনের বুক আর পেটের উপর তার বুক আর শরীরের কিছুটা অংশ লেপ্টে রয়েছে। সে কিছুটা শান্ত হলে সুজন তার মাথায় পিঠে ধীরে ধীরে হাত বুলায়। এক সময় সহসা রেখা তার বুকে ফুঁপিয়ে কাঁদে কিছুক্ষণ। সুজন কিছু বলে না। একইভাবে তার মাথায়, চুলে আর পিঠে হাত বুলিয়ে যায়। তার হাত দিয়ে যেন অন্তহীন মমতা নদীর স্রোতের মত, জ্যোৎ
স্নার স্নিগ্ধ আলোর মত রেখার শরীরে ঝরে পড়তে থাকে। রেখা এক সময় অস্ফুট স্বরে তার বুকে মাথা রেখেই স্বগতোক্তির মত বলে, আপনি আমাকে ভালবাসেন না।

সুজন এর উত্তর দেয় না। ওর মাথার চুলে বিলি কাটতে থাকে।

আর কিছুটা সময় পর রেখা উঠে বসে। তাড়াতাড়ি পিছন ফিরে বসে কাপড় গুছিয়ে নেয়। চোখ-মুখ ভাল করে মোছে। চুলটা ঠিক করে। সুজন শুয়ে শুধু ওকে দেখে। না কি দেখে না? হয়ত তার চোখ তাকে দেখে। কিন্তু তার মন হয়ত তখন অনেক দূরের কোনো পৃথিবীতে। সে পৃথিবীকে কি রেখা চেনে?

রেখা খাট থেকে নেমে বলে, আমি এখন যাই।

সুজনও নামে। গাঢ় স্বরে বলে, রেখা একটু দাঁড়াও!

তারপর দু’হাত দিয়ে রেখার মাথাটা আলতো করে ধরে তার কপালে একটা চুম্বন করে। এর পর ধীরে ধীরে তার ঠোঁট উঠিয়ে নেয় তার কপাল থেকে, মাথা থেকে হাত দু’টো নামায়। রেখা একবার সুজনের বিষাদ মাখা দু’চোখে নিজের দু’চোখ রাখে। তারপর মাথা নীচু করে ধীরে ধীরে চলে যায়। সুজন দরজা পর্যন্ত এগিয়ে যায়। তার সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়া দেখে। সে আড়াল হলে দরজা দিয়ে নিজের ঘরের জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়।

সে বোঝে রেখা আর কোনোদিন তার কাছে আসবে না। হয়ত সে তার সঙ্গে তার বন্ধুর বাসায়ও আর দেখা করবে না। সে জানালার পর্দা সরায়। সামনের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে। বাইরে তখন ফাল্গুনের সকালের রোদ সোনালী ধারায় গলে পড়ছে। দক্ষিণ হাওয়া ক্ষণে ক্ষণে নারিকেল পাতায় দোল খেয়ে যায়। সামনের মাঠ, গাছ, সারি সারি দালান সব কিছু ছাড়িয়ে তার দৃষ্টি তখন বহু দূর নীল আকাশের দিকে।

সে নিজেকে জিজ্ঞাসা করে। আমি কী চাই?

তার মনে টুকরো টুকরো স্মৃতি ঢেউয়ের পর ঢেউয়ে তাকে ঠেলে নিয়ে যায় বাস্তব থেকে অবাস্তবের কোনো কিনারায়। এক সময় সে যেখানে এসে থামে সেটা হল একাত্তরের এক রণক্ষেত্রের দৃশ্য। শহর আর গ্রামের কিছু ছাত্র-যুবক আর গ্রামের কিছু কৃষক নিয়ে যে বাহিনী গঠন করা হয়েছিল তার একজন সদস্য হিসাবে সে তখন লড়ছিল। সামনে পাকিস্তানী বাহিনী আর পিছনে মুজিব বাহিনী। দুই বাহিনীর আক্রমণে তারা শেষ পর্যন্ত আর টিকতে পারে নাই।

স্বপ্নের মত দেখতে পায় তার সাথীদের অনেকে কীভাবে একে একে মারা যায়। কেউ কেউ গুরুতরভাবে আহত হয়। সে নিজেও আহত হয়। তাদের মধ্যে যে কয়জন শত্রুর হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারে সে তাদের একজন।

তারপর কতকাল কেটে গেছে। মাঝখানে কত ওলটপালট। সে কী চেয়েছিল। কী হল! জীবনের কত সুখস্বপ্ন মরে গেছে। কিন্তু রক্তের ঋণ শোধ করা হল না। তার ভিতরটা হুহু করে ওঠে।

সে একাত্তরের রণক্ষেত্র স্মৃতিপটে আবার আনতে চায়। এবার সহসা মনে রোমাঞ্চ জাগে। তার দৃষ্টি যেখানে গিয়ে পড়ে সেটা আর এক অচেনা রণক্ষেত্র। সে দেখতে পায় সে একটা স্টেনগান ধরা। আরো অনেকের মাঝে। তাদের বাহিনী মার্চ করে চলেছে। ফোয়ারার মত ছুটে যাওয়া গুলির শব্দ সে শুনতে পায়। বারুদের ধোঁয়ার আঘ্রাণ সে বুক ভরে টেনে নেয়।

বাস্তব অতিক্রান্ত কোনো জগতে যেন সে দাঁড়িয়ে একটা কবিতার কয়েকটা লাইন উচ্চারণ করে,

ফুল আমাকে যতই কাঁদাক, যুদ্ধই আমার নিয়তি;
কাজেই এখানেই নিই বিদায়, বহুদূর পথ আমাকে যেতে হবে।
জীবন তো এমনই, হয়ত সে ফুল হয় অথবা কাঁটাগাছ
যেমনই সে হোক যেখানে এবং যখন, শুধু জানি
আমাকে আবার যুদ্ধে যেতে হবে।

একটু সময়ের জন্য সে স্তব্ধ হয়ে থাকে। তারপর আপন মনে বলে, রেখা! - এইটুকু বলে কিছুক্ষণ সে থেমে থাকে। তারপর আবার বলে, তোমার বিশ্বাসের অমর্যাদা করতে পারি নাই।

একটু সময়ের জন্য আবার থেমে উত্তর জানা আছে জেনেও অদৃশ্য রেখার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে, তুমি কি কখনো যুদ্ধে যাবে?

এই রকম এক মুহূর্তে, সে কী চায়, তার অনেকটাই তার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়।

Facebook Twitter RSS